মঙ্গলবার, ৯ আগস্ট, ২০১১

রামদা উঁচিয়ে শিক্ষকদের তাড়া করল ছাত্রলীগ

ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুই ছাত্রকে পুলিশে সোপর্দ করায় ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) ক্যাম্পাসে তাণ্ডব চালিয়েছে। সংগঠনের সদস্যরা গতকাল সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর এবং শিক্ষকদের ওপর চড়াও হয়। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রামদা, রড ও লাঠিসোঁটা নিয়ে শিক্ষকদের ধাওয়া করে। হামলায় কমপক্ষে ২০ শিক্ষক আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে গুরুতর আহত একজনকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শিক্ষক সমিতি এ ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবি করে আজ মঙ্গলবার থেকে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে।
বাকৃবির শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন এলাকায় ছিনতাই করার অভিযোগে গত রবিবার বিকেলে নিরাপত্তাকর্মীরা দুই ছাত্রকে আটক করেন। তারা হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের আবাসিক ছাত্র নূর মোহাম্মদ ও ফজুলল হক হলের আবাসিক ছাত্র আরিফ। এই দুই শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি শামসুদ্দিন আল আজাদের সমর্থক বলে জানা গেছে। তারা আটক হওয়ার পর প্রক্টর আবু হাদী নূর আলী খানের নির্দেশে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয় তাদের। এরপর রাতে ছাত্রলীগের সভাপতির সমর্থক নেতা-কর্মীরা প্রক্টরের গাড়ি ভাঙচুর ও তাঁর বাসায় গিয়ে গালাগাল করে।
প্রক্টরের সঙ্গে এমন আচরণের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি গতকাল দুপুর ১২টার দিকে মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের গ্যালারিতে জরুরি সভা করে। পরে দুপুর ১টার দিকে ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিতে মৌন মিছিল বের করেন শিক্ষকরা। মিছিল চলার সময়
ক্যাম্পাসের জব্বারের মোড়ে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী শিক্ষকদের কটূক্তি করে। এতে কয়েকজন শিক্ষক ক্ষিপ্ত হয়ে চারজন শিক্ষার্থীকে জামার কলার ধরে টেনে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূর আলম, হাবিব, রাসেল ও তপু নামের ওই চার ছাত্রলীগ কর্মীকে পুলিশের হাতে তুলে দেন।
পুলিশ জানায়, এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা প্রক্টর কার্যালয়ের সামনে শিক্ষকদের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। তাদের সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষকের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রামদা, রড ও লাঠিসোঁটা নিয়ে শিক্ষকদের ধাওয়া করে এবং ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। ছাত্রলীগের হামলায় অন্তত ২০ জন শিক্ষক আহত হন বলে শিক্ষক সমিতি দাবি করেছে। ইটের আঘাতে পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সুবাস চন্দ্র দাস মারাত্মক আহত হন। তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা প্রক্টর কার্যালয়, ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টার কার্যালয়, টিএসসি, প্রশাসন ভবন, কৃষি অনুষদ ভবন ও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু স্থাপনায় ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাস ও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ব্যবহৃত কয়েকটি মোটরসাইকেলও ভাঙচুর করে। দুটি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
হামলার পর শিক্ষক সমিতির নেতারা উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এ সাত্তার মণ্ডলের সঙ্গে বৈঠক করেন। শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেন, 'গত রবিবার রাতে প্রক্টরের গাড়ি ভাঙচুর ও বাসায় হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষক সমিতি অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছে। এ ছাড়া সমিতি উপাচার্যের কাছে আজ (সোমবার) শিক্ষকদের ওপর বর্বরোচিত হামলায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে। আগামীকাল (মঙ্গলবার) সকাল ১১টায় দায়ীদের বিচার করা না হলে দুপুরে শিক্ষক সমিতি জরুরি সভা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার জন্য উপাচার্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কায় উপাচার্য তাতে রাজি হননি।
শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন উপাচার্য। এর পর পরই পুলিশ শিক্ষকদের কটূক্তি করার অভিযোগে আটক করা চার ছাত্র নূর আলম, হাবিব, রাসেল ও তপুকে ছেড়ে দেয়। উপাচার্যের সঙ্গে বৈঠকের আগে ছাত্রলীগ সভাপতি শামসুদ্দিন আল আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, 'ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িতদের বিচার আমরাও চেয়েছি। ওই ব্যাপারে প্রশাসনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তবে আজ (সোমবার) শিক্ষকরা যেভাবে সাধারণ ছাত্রদের মারধর ও টানাহেঁচড়া করেছেন সেটি নিন্দনীয়। আমরা এর বিচার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, ছাত্রবিষয়ক উপদেষ্টা, শিক্ষক সমিতির সভাপতির পদত্যাগ চাই। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের দাবি না মানলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করবে।'
কোতোয়ালি থানার ওসি গোলাম সরোয়ার রাতে কালের কণ্ঠকে জানান, রবিবার গ্রেপ্তার করা দুই ছাত্রকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া অন্য চার শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতিক্রমে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ক্যাম্পাসে প্রায় দেড় শ পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আবু হাদী নূর আলী খান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এ সাত্তার মণ্ডলের মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। (কালেরকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ 9/8/2011)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন